আজ সবুজের আমন্ত্রণে, শাল-সেগুনের বনে, তিতির-তোতার আহ্বানে - জয়পুর জঙ্গল

আজ সবুজের আমন্ত্রণে
 

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।

সত্যি, জীবনে যা কিছু সহজে পাওয়া যায় তা বোধহয় আমাদের তেমন টানে না। এভাবেই আমাদের চারিপাশে ছাড়িয়ে থাকা বহু মণিমাণিক্য আমাদের অগোচরে থেকে যায় । তেমনি এক মানিক্য জয়পুর জঙ্গল। ভাবছেন সেটা সুদূর রাজস্থানে, কম করে এক সপ্তাহের ছুটি চাই ? না, এই জয়পুর আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় অবস্থিত। সপ্তাহান্তে কোথায় যাবেন ভাবছেন? একবার সাড়া দিন সবুজের আহ্বানে। এটুকু ব্বলতে পারি আফশোষ করবেন না।

শাল সেগুনের ফন্দি

শহরতলী থেকে দূর, কোলাহলময় কলকাতাকে দূরে সরিয়ে রেখে ছুটি কাটানোর পক্ষে জয়পুর এক আর্দশ জায়গা । দু ধারে শাল -সেগুনের হাতছানি আর তারই মাঝে বাঁধানো রাস্তা বয়ে চলে গেছে । চারিপাশে এক ভীষণ প্রাণজুড়ানো নিস্তব্ধতা । পাখিদের কিচিরমিচির আপনাকে মানে করিয়ে দেবে যে কোলাহল আছে কিন্ত তা ভীষণ শ্রূতিমধুর । যদিও শাল আর সেগুনই প্রধান, তবে জঙ্গলে আমলা আর বহেরাও আছে। এই জঙ্গলটি ১২০ বর্গ কিমি অঞ্চল জুড়ে রয়েছে। রিসর্টটির পরিধির ভিতরে রয়েছে একটি ঘড়ি মিনার যেখান থেকে সবুজ ঘেরা জঙ্গলটিকে খুব ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় ।

স্থানীয় মানুষদের কাছে শুনেছিলাম এই জঙ্গলের এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করে না । শুনে রোমাঞ্চ জেগেছিলো, এমন তো আমাজন জঙ্গলেই হয় বলে জানতাম। জঙ্গলের মধ্যে ব্রিটিশ আমলে তৈরি কিন্ত অধুনা পরিতাক্ত একটি এয়ার স্ট্রিপ রয়েছে যেটি আপনি দেখতে যেতেই পারেন। মানে রাখবেন বিকেল ৪টের পারে জঙ্গল কিন্ত নিরাপদ নয় । বরং সকালের টাটকা মিঠে রোদে গা ডুবিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন জঙ্গলকে চিনে নিতে।

বিকেলের সোনাঝরা রোদ গাছেদের গা চুঁয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। রাতের সলমা জরি জড়ানো আকাশের নিচে কি অসীম নিস্তব্ধতা। নাম না জানা এক পাখি সেই নীরবতাকে খান খান করে আমাদের রিসর্টের পাশ দিয়ে চলে গেলো। জোৎস্না রাতের আবেশ আরো মোহময়; কি যে এক মন ভালো করা মায়া জড়ায় । আসবার সময় বলে এসেছিলাম গাছেদের কানে কানে, আমি তোমাদের কাছে ফিরে আসবো ।
 

হরিণ, হাতি ..............জঙ্গলের সাথী

গায়ে ফুট ফুট দাগ যুক্ত চিতল হরিণের দেখা সহজেই মেলে । আর হ্যাঁ , হাতিও আছে যদিও তাদের দেখা মেলা ভার । তবে শীতকালে এলে তাদের দেখা অপেক্ষাকৃত সহজে মেলে । বন্য হাতি জঙ্গল পার হচ্ছে - এই দৃশ্য মনের ক্যামেরায় সারা জীবন বন্দি করে রাখার সুযোগ খুব কম মেলে।

পাখিদের এই পাঠশালাতে

কলকাতার বহুতলগুলির মাঝে পরে সূর্য্য চিড়েচ্যাপ্টা আর পাখিরা নিরুদ্দেশ। আমাদের ছোটোবেলায় দেখা চড়ুই আর শালিক আর স্নান করে না সকালের মিঠে রোদে, বড়ো অভিমানে তারা আজ প্রবাসী । 'পাখিসব করে রব , রাতি পোহাইলো' খুব মনে পরবে ছোটবেলার এই কবিতাটি জয়পুর জঙ্গল বেড়াতে এলে। তোতাপাখি বেশি তবে আরো অনেক প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায় সারা বছর জুড়ে।

আনাচে কানাচে

বিষ্ণুপুর মন্দির নগরী হিসেবেও প্রসিদ্ধ এবং জয়পুর থেকে মাত্র ১৪কিমি দূরে অবস্থিত। সতেরোশো সালে নির্মিত বিষ্ণুপুর শহরটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। যেদিকে দুচোখ যায়,, টেরাকোটার মন্দির আর ঐতিহাসিক স্থাপত্য মন জুড়ায়।

রসমঞ্চ হল এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মন্দির । ষোলোশো শতকে রাজা বীর হাম্বিরের আমলে তৈরি ইট দ্বারা নির্মিত সবথেকে পুরোনো মন্দির এটি । অন্যান্য প্রসিদ্ধ মন্দিরগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৬৪৩ সালে রাজা রঘুনাথ সিংহের আমলে তৈরী পঞ্চরত্ন মন্দির, ১৬৫৫ সালে রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ দেবের আমলে নির্মিত জোড় বাংলা মন্দির ,,১৬৯৪ সালে তৈরি মদনমোহন মন্দির, ১৬৫৮ সালে নির্মিত লালজিৎ মন্দির, নন্দলাল মন্দির ইত্যাদি । সতেরোশো শতকে মল্লার রাজাদের আমলে তৈরি সব মন্দির ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল।

মন্দির ব্যতীত বিশেষ দ্রষ্টব্য হল মল্ল রাজাদের আমলে তৈরি ৩.৮মিটার দীর্ঘ এবং ৩০সেমি ব্যাস বিশিষ্ট ডালমাদাল কামান। মল্ল রাজারা এটি তৈরি করেছিলেন মারাঠাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে । এছাড়াও বিষ্ণুপুরের চারপাশে কিছু মন্দিরের ধবংসাবশেষ দেখা যায় যেমন মল্ল রাজাদের তৈরি কুখ্যাত গুমঘর , লাল বাঁধ লেক,পাথর দরজা (শহরের প্রধান প্রবেশ দ্বার), নূতন মহল ইত্যাদি ।

জয়রামবাটি আর কামারপুকুর, যা কিনা যথাক্রমে মা সারদা এবং রামকৃষ্ণ দেবের জন্মস্থান, জয়পুর থেকে মাত্র ৫৩ কিমি দূরে অবস্থিত । মাত্র ৮০কিমি দূরে অবস্থিত মুকুটমণিপুর বাঁধটিও পর্যটকদের কাছে একটি অন্যতম আকর্ষণ। ঘুরতে যেতে পারেন ৩১কিমি দূরে পাঁচমুড়া গ্রামে। এই গ্রামটির বিশেষত্ব হল এখানে প্রায় প্রতিটি পরিবার টেরাকোটার ঘোড়া আর গয়না তৈরি করে। ঝিলিমিলি আর শুশুনিয়া পাহাড় বেশি দূরে নয় ; ঘুরে আসতেই পারেন দিনের বেলা একটু সময় করে। সতেরোশো সালে নির্মিত পাহাড়ের উপরে অবস্থিত দূর্গা মন্দিরটি, যেটি কপিষ্ঠা মন্দির হিসেবে খ্যাত, জয়পুর থেকে মাত্র ৬০কিমি দূরে। তবে এই মন্দির দেখার সময় রসুন ,পিঁয়াজ নিয়ে যাওয়া যাবে না । এছাড়াও দেখার জায়গার মধ্যে আছে মেজিয়া ও পায়রাডোবা জঙ্গল ।
 

বিকি-কিনি

টেরাকোটার তৈরি গয়না এবং ঘর সাজানোর টুকিটাকি দেখলে প্যাকেটবন্দি করার ইচ্ছে কার না হয়? টেরাকোটার জিনিসগুলির কারুকাজ সত্যি অপূর্ব । এই কুটির শিল্পটি এখানকার বহু পরিবারের রোজগারের একমাত্র উৎস । একটু দরদাম করে কিনলে অনেক সস্তায় পেয়ে যাবেন । এছাড়াও পাবেন ডোকরার সামগ্রী। শাড়িপ্রেমীরা ঘুরে দেখতে পারেন বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত বালুচরী সিল্ক, আর বিষ্ণুপুরী সিল্কের বিশাল সম্ভার ।

কিনতে প্যারেন দশাবতার তাস যদিও তা দুষ্প্রাপ্য । ব্রিটিশদের প্রবর্তিত তাস খেলা হয় চৌকো তাসে । কিন্তু তার বহু আগে থেকেই মুঘল সম্রাট হুমায়ুন-আকবরের সময় থেকে চিত্রবিচিত্র গোলাকার তাসে 'গঞ্জিকা' তাস খেলা ছড়িয়ে পারে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় । মহারাজা বীর হাম্বীর গুরু শ্রীনিবাসের সঙ্গে গিয়েছিলেন বৃন্দাবনে তীর্থ করতে। সেই সময় তিনি এই তাস খেলা দেখে আকৃষ্ট হন এবং বিষ্ণুপুরে গোলাকার তাস খেলার প্রবর্তন করেন। এই তাস খেলা গঞ্জিকা তাস খেলার থেকে আলাদা এবং একটু কঠিন বটে । এই দশাবতার তাস খেলা ক্রমে ক্রমে জনপ্রিয়তা অর্জন করে বিষ্ণুপুর এবং সংলগ্ন এলাকায় । পাটুয়া পাড়ায় প্রত্যেক বাড়িতে তৈরি হতো এই দশাবতার তাস । এখন এই তাস খেলার প্রচলন আর নেই। শুধুমাত্র বিষ্ণুপুরের মনসাতলার ফৌজদার পারিবার এখনো তৈরি করে এই তাস। পুরো এক সেট দশাবতার তাসের দাম কিছু কম নয় । বিদেশি পর্যটকরা এলে এই তাস কিনে নিয়ে যান।
 

টুকি-টাকি

সঙ্গে করে নিয়ে যেতে ভুলবেন না টর্চ,আর ফার্স্ট এইড বাক্স । হ্যাঁ , আর সঙ্গে ক্যামেরা তো থাকবেই ।

কিভাবে যাবেন

বিমান পথে যেতে হলে কলকাতা এবং জামসেদপুর সবচেয়ে কাছের ত্রয়ারপোৰ্ট ।

ট্রেনে যেতে হলে আরণ্যক ত্রক্সপ্রেস, ত্রইচ ডবলু ত্রইচ বিক এসি পাস, সিকে পি পাস, রূপসী বাংলা ত্রক্সপ্রেস ।

বাসে করে যেতে হলে কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরগামী অনেক সরকারী এবং বেসরকারী বাস আছে ।
 

কোথায় থাকবেন

থাকতে পারেন জয়পুর জঙ্গল সংলগ্ন রিসর্টটিতে । রিসর্টটিতে পর্যটকদের জন্যে সমস্তরকম আধুনিক সুবিধা আছে। ঘন জঙ্গল পরিবেষ্টিত রিসর্টটির হাতার মধ্যেই রয়েছে নিজস্ব শাকসবজির বাগান আর বিশাল ঝিল ।

কখন যাবেন

গরম ছাড়া যে কোনো সময়ে এই জায়গা ঘোরার পক্ষে আদর্শ । আর যদি আপনি আঞ্চলিক সংস্কৃতির ভক্ত হন , তাহলে জয়পুর জঙ্গল ভ্রমণের আদর্শ সময় হল ২৩-২৭শে ডিসেম্বর। এই সময় প্রতিবছর বিষ্ণুপুরে বিশাল মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

কি খাবেন

বাঙালি রান্নার মধ্যে মাছ,মাংসের বিভিন্ন পদগুলি খেয়ে দেখতে পারেন । খামারের নিজস্ব আনাজগুলোর স্বাদ আলাদা । চাইলে উওর ও দক্ষিণ ভারতের পদগুলোও পাবেন এখানে । এখানের রেস্তোরাগুলির রান্না কলকাতার যেকোনো রেস্তোরার রান্নার সাথে তুলনা করা যেতে পারে । এখানে অতিথিশালায় কোনো পানশালা নেই,, তার জন্যে আপনাকে যেতে হবে বিষ্ণুপুর ।