গোঙ্গনি গিরিখাত - ঘুরে আসুন বাংলার কলোরাডো

পশ্চিমবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অপরিসীম এবং বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য্যের অনেকটাই এখনো অনাবিষ্কৃত। উরু উরু মন চাইছে কি একটু অন্যরকম এডভেঞ্চার? তাহলে চলুন গোঙ্গনি । বাংলার গিরিখাত হিসেবে এই জায়গাটি এখনো জনপ্রিয় নয়, তাই ভ্রমণ -বিলাসী বাঙালির দেখা খুব কম পাওয়া যাবে।

গিরিখাত বললেই প্রথমেই যে নামটি মনে পরে তা হলো আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী আরিজোনার গিরিখাত। মহাবালেশ্বরের গিরিখাতটি ভারতের একটি অন্যতম দ্রষ্ট্ব্য । অথচ আমাদের পশ্চিমবাংলায় অবস্থিত পশ্চিম মেদিনাপুরের গড়বেতার গোঙ্গনির গিরিখাতটি যে আরিজোনার গিরিখাতটির সদৃশ তা অনেকেরই অজানা। তবে আরিজোনা যেমন পাহাড়ী জায়গা, গড়বেতার ধারে কাছে কিন্ত কোন পাহাড় নেই।

এখানকার স্থানীয় মানুষের কাছে এই গিরিখাতটি গোঙ্গনি ডাঙ্গা বা গোঙ্গনি খোলা হিসাবে পরিচিত। বাংলার সমতলভূমিতে এই ধরণের ভূমির গঠন একরকম অপ্রত্যাশিত এবং সেই কারণে এই গিরিখাতটিকে বাংলার বৃহৎ গিরিখাত বলা হয়। লাল মৃত্তিকায় আবৃত এই গিরিখাতটি শিলাবতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। জায়গা অনুসারে কোথাও এই মাটির রং গাঢ় লাল, আবার কোথাও বা তা হালকা লাল। শিলাবতী নদীর শান্ত রূপ এই অঞ্চলকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। নদীর আরেকদিকের সমতলভূমিতে আলু এবং সর্ষের চাষ হয়। নদীর দুধারে এই রংবাহার সত্যিই মনোরম । বছরের পর বছর ধরে উপর থেকে নিচ অবধি জল বয়ে যাওয়ার দরুন মাটির যে ক্ষয় হয়েছে, তার থেকেই এই গিরিখাতের উৎপত্তি। এর ফলে ভূমির গঠন কোথাও জন্তজানোয়ারের মত মুখের আকৃতি, কোথাও বা তা মন্দিরের মত, কোথাও বা গুহা বা রাজপ্রাসাদের মত হয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এ যেন কোনো দক্ষ শিল্পীর নিপুন হাতের কাজ । ল্যাটেরাইট সমৃদ্ধ লাল মাটি গোঙ্গনির বুকে লাল আলো বিচ্ছুরণ করছে। সকালের বিচ্ছুরিত মিঠে রোদে এই গিরিখাতটিকে আরো আকর্ষণীয় ও রহস্যময় মানে হয়।

গিরিখাতটির সবথেকে উঁচু জায়গাটি লাল মাটির দ্বারা আবৃত কিন্তু নিচের দিকে আসার সময় তা ক্রমশ হলদেটে বর্ণ ধারণ করেছে। মিষ্টি মধুর রোদের ছায়ায় সমগ্র গিরিখাতটিতে সোনালী রং লেগেছে। মার্চ মাসে এখানে নদীর জল গোড়ালি অবধি থাকে, তখন সহজে এই নদী পার হওয়া যায়। বর্ষাকালে এই নদীর জল গিরিখাতের কিছু অংশে ঢুকে পরে এবং সেই সময় মৎস্যজীবীরা মাছের লোভে এখানে জাল ফেলে। ঝড় হওয়ার আগে প্রকৃতিতে যে শান্তভাব বিরাজ করে, গোঙ্গনির অবস্থা ও সেইরকম । শীলাবতী নদীর উপর রেলওয়ে ব্রিজ আছে। যখন ব্রিজের উপর দিয়ে সব নীরবতাকে এক নিমেষে খান খান করে ট্রেন যায়, তখন এক অনির্বচনীয় রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। এখানকার সাথে অজন্তা ইলোরার স্থাপত্যকলার অনেক মিল পাওয়া যায়।

পুরাণ কথা

গোঙ্গনির একটা ঐতিহাসিক দিক আছে। বলা হয় যে পাণ্ডবদের বনবাসকালে পাণ্ডবপুত্র ভীম এখানে বাস করতো এবং সেইসময় রাক্ষস বকাসুরাও এই গিরিখাতে বাস করত। পাণ্ডবপুত্র ভীম এখানেই বকাসুরার সাথে যুদ্ধ করেছিল এবং তাকে পরাস্ত করেছিল। যদিও বিষয়টি বিতর্কিত কারণ এখানে রামপুরহাটের কাছে একচক্ররা বলে একটা জায়গা আছে এবং এই একচক্ররাকেই মহাভারতের একচক্রপুর বলে মনে করা হয়। তবে একচক্রের কাছে কোনো পাহাড় নেই আর গোঙ্গনি একচক্ররের থেকে ২০৭ কিমি দূরে অবস্থিত । পান্ডবতলা বলে এখানে একটা জায়গা আছে যেখানে সারি সারি গাছ পুকুর বেষ্টন করে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বাস করা হয় বনবাসের সময় পাণ্ডবরা এখানেই থাকতো।

কাছাকাছি

গোঙ্গনি ছাড়াও এখানে আকর্ষণীয় জায়গাগুলি হলো গড়বেতার পুরানো মন্দিরগুলি। তার মধ্যে অন্যতম হল রাধানাথ সিংহ স্মৃতি মন্দির যা
সিংহ পাড়ায় আছে। এছাড়াও আছে সর্বমঙ্গলা মন্দির এবং তার কাছাকাছি কংগ্রেশ্বর মন্দির ,এবং রত্না মন্দির। এছাড়াও দর্শন করতে পারেন সিংহী বাড়ির ভগ্নস্তূপ ও আগস্তি পরিবারের বাড়ি।

গড়বেতার পাথরের মন্দিরটিকে গোলাপি রং করা হয়েছে পর্যটকদের আকর্ষণ করবার জন্যে। এর ফলে, এই মন্দিরটি শুধুমাত্র তার স্বাভাবিক সোন্দর্য্যই হারাইনি ,যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে।

কিভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে গড়বেতা ১৭৮ কিমি দূরে । কলকাতা থেকে গোঙ্গনি দুভাবে যাওয়া যায়। ,গাড়ি করে যেতে হলে কলকাতার থেকে এন এইচ ৬ ধরে বাগনান হয়ে উলুবেড়িয়া। সেখান থেকে দুটো রাস্তা আছে গোঙ্গনি পৌঁছাবার - ঘাটাল হয়ে চন্দ্রকোনা যেতে পারেন নাহলে এন এইচ ৬০ ধরে শালবনী যাওয়া যায়। এই দুটো জায়গা থেকেই গোঙ্গনির দূরত্ত্ব কয়েক কিমির।

ট্রেনে যেতে হলে হাওড়ার সাঁতরাগাছি থেকে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস ধরতে হবে যা প্রতিদিন সকাল ৯টার সময় ছাড়ে এবং ৯.৪৩ এ গড়বেতা পৌঁছায়। অবশ্যি দশদিন আগে থেকে আপনাকে টিকিট বুক করতে হবে। স্টেশন থেকে গোঙ্গনি পৌঁছনোর জন্য বাস বা ট্রেকার নেওয়া যেতে পারে। স্টেশনে সাইকেল ভ্যান সবসময় থাকে যা গোঙ্গনি পৌঁছতে সাহায্য করবে। গোঙ্গনি থেকে ১০ কিমি দূরে আছে গড়বেতা শহর। ডানদিকে গড়বেতা কলেজকে অতিক্রম করে সাইকেল ভ্যান বাঁদিকে মোড় নিলে লাল মাটির দেশ। রাস্তার গাছগুলো সারি বেঁধে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। একটু দূরেই একটা সাইন বোর্ড আছে যেখানে পিকনিকে আসা যানবাহনগুলির ক্ষেত্রে টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে । একটু ডানদিকে মোড় নিলেই দেখতে পাওয়া যাবে বৃহৎ গিরিখাতকে।

কোথায় থাকবেন

গোঙ্গনির থেকে ১০ কিমি দূরে আছে গড়বেতা শহর। গড়বেতা কলেজের কাছে আছে সুরুচি হোটেল । রিয়া হোটেল আছে গুঞ্জন ভিডিও হলের বিপরীতে । হোটেলগুলিতে খাওয়ার গুণগত মানও খারাপ নয়। তবে গোঙ্গনিতে থাকবার কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। তবে ধারে কাছের মধ্যে বিশেষত গড়বেতা এবং বিষুনুপুর শহরের মতো উন্নত জায়গায় থাকা যেতেই পারে। এখানে মোটামুটি সবরকমের সুযোগ সুবিধা পাওয়া সম্ভব।
বিষ্ণুপুরে অনেক সরকারি আবাসন আছে যেখানে থাকা যেতে পারে। তবে গোঙ্গনিতে যেতে হলে ব্যাগে জলের বোতল এবং শুকনো খাওয়ার নিয়ে যাওয়া ভালো।

কখন যাবেন

গোঙ্গনির শান্ত পরিবেশটি যারা পিকনিক করতে আসে তারা সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিয়েছে। ছুটির দিনে এখানে না আসাই ভালো। শান্তভাবে জায়গাটা দেখাটাই মাটি হয়ে যাবে । এখানে রাজনৈতিক কারণে পরিবেশটা শান্ত নয়, তাই সন্ধ্যের পরে এখানে না থাকাটাই ভালো।