বিচিত্রপুর, ম্যানগ্রোভ আর সুবর্ণরেখা - জীবনের মরুপথে জলছবি এঁকে যায়

ভ্রমণপিপাসু বাঙালির কাছে সমুদ্র মানেই হয় পুরী না হয় দিঘা। এবার .আপনার ভ্রমণ মানচিত্রে একটা নতুন জায়গা যোগ করুন। বিক্ষিপ্ত মনটা যদি ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় সমুদ্র তটে, পাড়ি দিন দিঘার থেকে ১৫ কিমি দূরে উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলার অন্তর্গত বিচিত্রপুরে ।

' বিচিত্র ' কথাটির অর্থ হল নানারকম। ' পুর ' মানে জায়গা। সমুদ্র আর ম্যানগ্রোভের গভীর প্রেমে জায়গাটি সত্যি ভিন্নভাবে মনোরম। উড়িষ্যার বনভূমি উন্নয়ন কর্মসূচী অনুসারে বিচিত্রপুরের ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের কাজ শুরু হয়েছে। ম্যানগ্রোভকে নিয়ে নূতন আলাপআলোচনা, সংরক্ষণের প্রয়াস আশার আলো জাগায়। সরকারের এই সাধু প্রচেষ্টা থেকেই জনগণ এই অঞ্চল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছে। আমাদের মতন দেশে যেখানে বড়ো বড়ো ইমারত বানানোর জন্য এবং পয়সার লোভে গাছ কাটা হচ্ছে, সেখানে এই ধরণের বন উন্নয়নের কর্মসূচি প্রশংসার দাবি রাখে ।

শহরের ব্যাস্ততা কে দূরে সরিয়ে নির্জনতাকে যদি সঙ্গী করতে মন চায়, তাহলে ২-৩ দিনের জন্য ঘুরে আসুন বিচিত্রপুর । আলস্য কাটিয়ে প্রাতঃ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ুন, নিশ্বাস নিন প্রাণভরে । গ্রামের প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে কখন যে নিজের খেয়ালে হারিয়ে যাবেন যাবেন টেরই পাবেন না। মনের ক্লান্তি ধুয়ে মুছে এযেন এক নূতন সকালকে আবিষ্কার করা। গ্রামগুলি ভারী সুন্দর , লক্ষ্য রাখুন ওড়িশা সরকারের প্রতীকগুলির দিকে যা দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।

বিচিত্রপুরে নির্জনতা ,নীরবতা নিরালা মিলেমিশে ঘিরে এক অমোঘ শান্তির পরিবেশ তৈরি করেছে। সাগরে ডুব দিলে আপনার শরীর ও মনের ক্লান্তি এক নিমেষেই উধাও হয়ে যাবে । যোগাযোগ করতে পারেন হোটেল কোরাল দিঘার সাথে। এটি একটি বিলাসবহুল অত্যাধুনিক হোটেল । এখানে এসে নৌবিহারের রোমাঞ্চ নিতে ভুলবেন না। ম্যানগ্রোভ অধ্যুষিত জায়গা না ঘুরলে বিচিত্রপুর ভ্রমণ সম্পূর্ণ হবে না। । সুবর্ণরেখা মোহময়ী আর তার সাথে রয়েছে সুমুদ্রের জ্বলোচ্ছাস। ম্যানগ্রোভের হাতছানি কি উপেক্ষা করা যায় ? একদিকে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সোঁদা গন্ধ অন্যদিকে আকাশ বাতাস মাত্ করা কত নাম না জানা পাখির কলরব । সমুদ্রের জলের আওয়াজ আপনার মনকে ব্যাকুল করে তুলবে। জল বিছানায় সাদা তুলোর অবিরত অথচ সংযত আকুলি-বিকুলি আর মাথার উপর চুমকি বসানো নীল সামিয়ানা - আর কি চাই নিজের সঙ্গে একাত্ম হতে।

এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা এই ম্যানগ্রোভ অঞ্চল থেকে কাঠ সংগ্রহ করেন জ্বালানির জন্যে। এটিও ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিলুপ্তির অন্যতম একটি কারণ।

নৌবিহার

সুমুদ্র সৈকতে যাওয়ার জন্য মোটর ভ্যান বা অটোই যথেষ্ট তবে ওঠার আগে ভাড়া নিয়ে দরাদরি করে নেবেন। নতুন লোক দেখলে এরা দামটা বাড়িয়ে বলে। এখানে এসে নৌবিহারের সুযোগ ছাড়বেন না। নৌবিহারে ৬-৮ জনের বসার ব্যাবস্থা আছে , ভাড়া মাথাপিছু ১০০০ - ১২০০ টাকার মধ্যে। এখানে যাওয়ার সময় সকাল ১০:৩০ থেকে বিকেল ৫:৩০ অবধি। সাঁতার না জানা থাকলে সাবধান কারণ এরা কোনো লাইফ জ্যাকেট দেয়না , তাই জলে ভেসে থাকবার মত জিনিস নিয়েই নৌবিহারে যাবেন। বাচ্চাদেরকে না নিয়ে যাওয়াই ভালো।

কাছাকাছি

এখানে অনেক সৈকত আছে যেমন তালসারি সৈকত, দিঘা সৈকত, মন্দারমণী সৈকত । কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে চান্দেরসর মন্দির এবং ভুবনেশ্বর মন্দির।

কচ্ছপ আর কাঁকড়ার বিচরণভূমি

জানেন কি বিলুপ্তপ্রায় Olive Ridley কচ্ছপ বিচিত্রপুরের সমুদ্র সৈকতে বাসা বাঁধে ও ডিম্ পাড়ে ? আমাদের ড্রাইভার জানালো যে বিচিত্রপুর এবং কীর্তনীয়াতে প্রস্তাবিত দুটি বন্দর এই কচ্ছপদের প্রজননের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে কারণ এরা জমায়েত ও মিলিত হয় সুবর্ণরেখা আর সাগরের সঙ্গমস্থলে ।

বিচিত্রপুরে প্রচুর লাল কাঁকড়া পাওয়া যায়। আকৃতিতে এরা যথেষ্ট বড় । সৈকতে হাঁটার সময় চোখে পড়বে তাদের দ্রুত আনাগোনা। লোক দেখলেই তাড়াতাড়ি এরা গর্তে ঢুকে যায়।

কিভাবে যাবেন

দিঘার থেকে বিচিত্রপুর যেতে ২ঘন্টা সময় লাগে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য অটো বা মোটর ভ্যান আছে। হাতের নাগালেই পেয়ে যাবেন মোটর ভ্যান বা অটো যা আপনাকে কিছুক্ষনের মধ্যে পৌঁছে দেবে। বাজেট যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলে এই অঞ্চলটিতে ঘুরতে যাওয়া কম রোমাঞ্চকর নয়। যাওয়ার পথেই দেখা মিলবে এঁকেবেঁকে যাওয়া রূপসী সুবর্ণরেখাকে । দিঘা থেকে বিচিত্রপুর যাওয়ার ১৮কিমি পথ জুড়ে সুবর্ণরেখার লুকোচুরি। এই নদী ঝাড়খন্ড থেকে উৎপন্না হয়ে ঘাটশিলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলে গেছে ওড়িশার বঙ্গোপসাগরে।

কোথায় থাকবেন

থাকার জায়গা হিসাবে দিঘা ভালো তবে ওটিডিসি চন্দ্রেশ্বর পান্থশালায় (সরকারী )পর্যটকদের জন্যে সুবন্দোবস্ত আছে।

দূরাভাষ ৯১৬৭৮১ ২৩২৫২৮/২১২৫০০

কি খাবেন

চন্দ্রেশ্বর থেকে ১০ কিমি দূরে একটি ভালো রেস্তোরা আছে। এটি হলো ওটিডিসি পান্থশালা যা তালসারিতে অবস্থিত। নূন্যতম দামে এখানে অসাধারণ খাওয়ার পাওয়া যায়। তবে সুবর্ণরেখা নদীর পার থেকে উঠে আসা লাল কাঁকড়ার স্বাদই আলাদা।

টুক-টাক

ম্যানগ্রোভ অরণ্য , সমুদ্র ,নৌবিহার এখানকার আকর্ষণ। এখানে খুব একটা দোকানপাট নেই ,দু একটা ছোট ছোট দোকান আছে তাতে সামান্য কিছু খাওয়ার পাওয়া যায়। যদি বাচ্চা সঙ্গে থাকে তাহলে তার খাওয়ার আর ওষুধ আনতে ভুলবেন না যেন। বড়দের জন্য ও কিছু শুকনো খাওয়ার রাখা উচিত। নৌবিহারে যাওয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ক্যামেরার উপর জলের ঝাঁপটা না লাগে,ক্যামেরা খারাপ হয়ে যেতে পারে। এখানে কোনো ছায়া ঘেরা জায়গা নেই যেখানে বয়স্ক ও বাচ্চারা রোদ বা বৃষ্টির সময় আশ্রয় নিতে পারে,তাই ব্যাগে সবসময় ছাতা রাখবেন। সবসময় জলনিরোধ জুতা ব্যাবহার করবেন।

শেষ হয়ে হইলো না শেষ

দিঘা নামটার সাথে আমরা যতটা পরিচিত ,দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিচিত্রাপুর জায়গাটির সম্পর্কে আমরা ততটা ওয়াকিবহাল নই। সারা বছরই এখানে ফাঁকা থাকে, লোকের সমাগম কম। তার একমাত্র কারণ হলো এই পর্যটন কেন্দ্রকে নিয়ে প্রচার অনেক কম এবং এখানে হোটেল ,রেস্তোরার সংখ্যা গুটিকয়েক। লোক এখানে আসে কম এবং আসলেও ১-২ দিনের বেশি থাকে না। এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য এবং পর্যটন শিল্পকে ত্বরান্বিত করতে সরকারী এবং বেসরকারী উভয় বিভাগকেই গিয়ে আসতে হবে।