হীরক রাজার দেশে

'প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্রকার সত্যজিς রায়ের হীরক রাজার দেশ' ছায়াছবিটি দেখেননি এরকম বাঙালি বোধহয় হাতেগোনা। ছবিটির কিছু অংশের শুটিং হয়েছিল পুরুলিয়ায়। পশ্চিমবাংলার এই জেলাটির প্রকৃতি বড় মনোরম। জেলাটির একটি বড় আকর্ষণ হল জয়চণ্ডী পাহাড়। এই পাহাড়টি কলকাতা থেকে মাত্র ২৬৩ কিমি দূরে অবস্থিত । ৮০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট জয়চন্ডী পাহাড়টি পাহাড়প্রেমীদের কাছে একটা অন্যতম আকর্ষণ। মা চন্ডি র নামানুসারেই এই পাহাড়টির নাম রাখা হয়েছে জয়চন্ডি পাহাড়।

চণ্ডী মাতার মন্দিরটি পরিদশর্নের জন্য তীৰ্থযার্থীদের ৫২০টা ধাপ অতিক্রম করতে হবে। যদিও এই রাস্তা অতিক্রম করা বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে একটু কষ্টকর তবে সঞ্চয়ের ঝুলিতে একটু পুণ্যের মাত্রা বাড়তি যোগ করার লোভে তারা বোধহয় পিছপা হবেন না। পাহাড়ের উপর থেকে পুরুলিয়া জেলাটির অপূর্ব রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়।

পাহাড়ের উপর যাওয়ার পথে চোখে পারবে একটি পরিত্যক্ত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র । বলা হয় বহু শত বছর আগে ডাকাতরা এই পথ ব্যবহার করত। মন্দির ছাড়াও পাশ্ববর্তী হ্রদ, একশিলার গঠনযুক্ত পাহাড়, গুহা এবং রঘুনাথপুর সিল্ক কারখানা পর্যটকদের কাছে বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান। প্রকৃতি এখানে শান্ত। মনোরম পরিবেশ অপরূপ হয়ে উঠেছে একাধিক হ্রদের উপস্থিতিতে। অবশ্যই ভুলবেন না সেখানে যেতে যেখানে সত্যজিৎ রায় হীরক রাজার দেশের শুটিং করেছিলেন।

জয়চন্ডী পাহাড় থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে ( মাত্র ২ কিমি ) আছে রঘুনাথপুর। এখানকার সিল্ক কারখানাটি খুব বিখ্যাত । এখানকার সিল্কের খ্যাতি শুধুমাত্র পুরুলিয়ার মধ্যেই আবদ্ধ নয়। পরিধার্শন করুন কারখানাটি। তাঁতিদের হাতে বোনা শাড়ী কেনার লোভ সামলাতে পারবেন না।

কাছে পিঠে

জয়চন্ডী পাহাড়ের কাছাকাছি থাকলে একটু সময় করে ঘুরে আসা যেতেই পারে আকর্ষণীয় জায়গাগুলিতে। জয়চন্ডী পাহাড় থেকে ২১ কিমি দূরে আছে গড়পঞ্চকোট । ঘন জঙ্গলময় এই উচ্চভূমি পাঞ্চেৎ হ্রদকে ঘিরে আছে। এই উচ্চভূমির যেদিকে চোখ যায় সেদিকে সবুজ আর সবুজ, যেন প্রকৃতি চারিপাশে সবুজ গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে । এখানে কিছু প্রাচীন মন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়। কিছু সামান্য কাঠামোর ধ্বংশবিশেষ আছে যা অতীত এই সমতল ভূমি এলাকার উপজাতীয় রাজাদের শেষ নিদর্শন হিসাবে মনে করা হয় ।

জয়চন্ডী পাহাড় থেকে ২৮ কিমি দূরে আছে মুরারদি হ্রদ। ,গারং পাহাড়ের পাদদেশে স্থিত শান্ত বোরান্তি গ্রামেও ঘুরে আসা যেতে পারে। মাত্র ৪৯ কিমি দূরে আছে বিহারীনাথ পাহাড় এবং ৮৫ কিমির মধ্যে আছে অযোধ্যা পাহাড়। একদিনের জন্যে সময় করে ঘুরে আসতে পারেন রঘুনাথপুর সিল্ক কারখানা,,মৈথুন হ্রদ (৪৫কিমি দূরে ), কৈলোস্বরী মন্দির এবং পঞ্চেত হ্রদ।

অন্যান্য আকর্ষণীয় জায়গাগুলি হলো ডি ভি সির নুতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র ,মৌতর বারো কালীমন্দির ,শংকরা মা কালিমন্দির ,পঞ্চকোট রাজবাড়ি, দুয়ার সিনি রামপুর বন।

ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে

পুরুলিয়ায় প্রকৃতি কৃপণ নয়। বিশেষ করে বসন্তের সময় প্রকৃতির শোভা অপূর্ব। তখন দেখতে পাবেন পলাশের লালিমা। রুক্ষ শুশুনিয়া আর জয়চন্ডীও যৌবনোচ্ছল। সে এক সত্যি রূপকথার দেশ - মায়া জড়ানো, নেশা ধরানো।

পর্বতারোহণ এবং পর্যটন শিল্প

যদি আপনি পাহাড়প্রেমী হন এবং পর্বতারোহণে আগ্রহী হন তাহলে যোগাযোগ করতে পারেন কলকাতা ও পুরুলিয়ার বিভিন্ন ট্রেকিং সংগঠনের সাথে। ট্রেকারদের কাছে সবথেকে বেশি প্রিয় শুশুনিয়া পাহাড়।

প্রথমাবস্থায় সরকার এখানকার পর্যটন শিল্প নিয়ে এতটা মনোযোগী ছিলেন না।,তবে এখন এখানে অনেক সরকারি আবাসন লক্ষ করা যায়। জানুয়ারী মাসের শেষে এখানকার অধিবাসীরা জয়চন্ডী পাহাড়ে পর্যটন উৎসবের আয়োজন করে। এখানে সত্যজিৎ রায়ের নামাঙ্কিত একটি মঞ্চ আছে যেখানে বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা অনুষ্ঠানা হয়। অনেক খ্যাতনামা লোক এই সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

শিল্পায়ন

ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন এই অঞ্চলে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রঘুনাথপুর শিল্প কারখানাটি কলকাতা থেকে ১২৫ কিমি পশ্চিমে এবং রাঁচির থেকে ১১৯ কিমি পূর্বে অবস্থিত। এই ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন এই অঞ্চলে ষ্টীল

এবং ধাতব কারখানা স্থাপন করেছে। এই কারখানাগুলি জাতীয় সড়কপথ ,রেলওয়ে স্টেশন ,বৃহৎ শ্রম বাজারের সাথে,এয়ারপোর্টের সঙ্গে যুক্ত

যার ফলে শিল্পের কাঁচামাল আনা নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। বিভিন্ন নামি ব্যাংকগুলি এই অঞ্চলে তাদের শাখা অফিস খুলেছে এবং এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে প্রচুর সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে ।

কিভাবে যাবেন

আপনি যদি কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে যেতে চান , তাহলে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে (বর্তমান নাম এশিয়ান হাইওয়ে ১ বা AH ১) .ধরে সোজা পৌঁছে যান আসানসোল । তারপর N H ৪১৯ ধরে ৪৭ কিমি এগোলে জয়চন্ডী পাহাড়।

আপনি যদি ট্রেনে করে যেতে চান, তাহলে সকালে হাওড়া থেকে আসানসোলগামী যেকোনো ট্রেন ধরুন আর সেখান থেকে স্থানীয় ট্রেন ধরে সোজা জয়চন্ডী রেলওয়ে স্টেশন।

যাওয়ার পথে আর একটু এডভেঞ্চার মন্দ কি? হাওড়া থেকে ধরুন রূপসী বেঙ্গল এক্সপ্রেস আর পৌঁছে যান আদ্রা স্টেশন। সেখান থেকে জয়চন্ডী পাহাড় গাড়িতে মাত্র ৮-১০ মিনিট । রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের একদম পাস দিয়ে। তবে এই ট্রেনটি রাতে ছাড়ে।

কখন যাবেন

বছরের যেকোনো সময়েই যাওয়া যায় তবে যারা পাহাড়ে উঠতে চান তাদের জন্যে আদর্শ সময় হলো ডিসেম্বর আর জানুয়ারী। মার্চ -এপ্রিলে গেলে পলাশের রঙে নিজেকে রাঙাতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন

জয়চন্ডী পাহাড়ের ধাপেই পেয়ে যাবেন মনোরম রিসর্ট যেখানে অত্যাধুনিক সমস্ত সুবিধা বর্তমান। রিসর্টটির হাতার মধ্যেই আছে সুন্দর সাজানো বাগান।

কি খাবেন

প্রাকৃতিক শোভা দেখার সাথে সাথে মন ভোলানো বিভিন্ন লোভনীয় ভারতীয় পদগুলিকে চাখা যেতেই পারে। মন্দ লাগবে না।

টুক-টাক

ক্যামেরা, টর্চ আর প্রয়োজনীয় ওষুধ নিতে ভুলবেন না। ডাইরী লেখার অভ্যাস থাকলে ওটি নিয়ে যেতে ভুলবেন না আর ভুলে ওখানে ফেলেও আসবেন না।